ঢাকা ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চালসহ অনেক পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য দিল বিবিএস

  • অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৭:১৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
  • ৩৩ বার পড়া হয়েছে

দেশের খাদ্য চাহিদার বড় অংশের জোগান দেয় চাল। এবার বোরোর ভালো ফলন ও রেকর্ড আমদানি সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ছে। দুই মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী থাকা চালের সঙ্গে বাড়ছে সবজি, ডিম, মাছসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। যদিও গত অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।সরকারি এ সংস্থা বলছে, গত জুনে মূল্যস্ফীতির হার কমে

৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে। একই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির পরও বিবিএসের মূল্যস্ফীতি কমার তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলছে। চালের দাম বাড়লে গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়ে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। কিন্তু বিবিএস তার বিপরীত চিত্র দিচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সময়ে বিবিএসের পরিসংখ্যান নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল, সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও রয়ে গেল।

গতকাল জুনের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, জুনে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এটি ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ দেখানো হয়েছিল। এ নিয়ে টানা চার মাস মূল্যস্ফীতি কমল। বিবিএসের দাবি, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তবে গত এক বছরে (জুলাই ২০২৪-জুন ২০২৫) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

বিবিএস বলছে, গত ছয় মাসে (ডিসেম্বর ২০২৪-জুন ২০২৫) সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। জানুয়ারিতে এটি ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ২৪, মার্চে ৮ দশমিক ৯৩, এপ্রিলে ৮ দশমিক ৬৩ ও মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সারা দেশের ৬৪ জেলার ১৫৪টি হাটবাজারের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জুনের মূল্যস্ফীতির চিত্র তৈরি করা হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে বাড়ার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি হিটম্যাপ অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হিসাবের ক্ষেত্রে চালের ভর ধরা হয় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সবজির ভর ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। খাদ্যের মোট ভরের প্রায় ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ চাল ও সবজির অবস্থান।

বিবিএসের আর কোনো সক্ষমতা তৈরি না হলেও সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য দেয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত দেড় দশকে বিবিএস সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য তৈরি ও সরবরাহে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছে। আমরা দেখেছি, অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ নির্ধারণ করলে বিবিএস সেটি প্রমাণের তথ্য-উপাত্ত হাজির করত। আবার জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও সরকারের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিবিএস বলত, মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশেও বিবিএস আগের মতোই তথ্য-উপাত্ত তৈরি করছে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ সংস্থাটির দাবি আর বাজারের পরিস্থিতি একই কথা বলছে না। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বমুখিতা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমল সেটির ব্যাখ্যা চাওয়া দরকার।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সবাই বলছে মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। আমার মনে হয়, সরকারের এ চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে বিবিএস পরিসংখ্যান তৈরি করছে। বিবিএস সংস্কার ও তথ্য সংশোধনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। আমরা এখনো জানি না, গঠিত ওই কমিটি কী সুপারিশ করেছে। আর সুপারিশ আমলে নিয়ে সরকার আদৌ কোনো সংস্কার করেছে বলেও শুনিনি। মূল্যস্ফীতির তথ্য দেখে মনে হচ্ছে, বিবিএস এখনো শেখ হাসিনার দেখানো পথেই চলছে।’

রাজধানীর বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই মাস ধরে চালের দাম বেড়ে চলছে। বাজারে নাজিরশাইল ও মিনিকেটের মতো সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ৩ টাকা বাড়লেও মাঝারি ও মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। মাঝারি পাইজাম, আটাশ চালের দাম কেজিপ্রতি ৭ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা, চায়না ইরি জাতের চালের দাম বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। মোটা চাল সব বাজারে পাওয়া যায় না বলে নিম্নবিত্তদেরও পাইজাম, আটাশ চাল কিনতে হয় বাধ্য হয়েই। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা যায়, গতকাল রাজধানীর বাজারে সরু চালের দাম ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়েছে। এক মাস আগেও এ চাল বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ৭২ টাকায়। মাঝারি চাল ৬০ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। এক মাস আগে এসব চালের দাম ছিল যথাক্রমে ৫৩ ও ৫০ টাকা।

কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘দুই মাস ধরে চালের দাম ৫-৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ৫০ টাকার মোটা চাল এখন ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, মাঝারি চাল বেড়েছে ৮ টাকা পর্যন্ত। কোরবানি ঈদের সময় থেকে দাম কমানো যায়নি। মিল মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

চালের দাম বাড়ার পেছনে চাল আড়তদার ও মিল মালিকদের দায়ী করেন খুচরা বিক্রেতারা। তারা বলেন, বোরো তোলার তিন-চার মাস না পেরোতে চালের দাম যেভাবে বেড়েছে তার পেছনে মিল মালিক ও আড়তদাররা দায়ী। তারা বোরো মৌসুমে কম দামে ধান কিনে রেখেছেন। তারা বলেন ধানের দাম বেড়েছে। কিন্তু ধানচাষীরা মূল্য পাননি। ধান ব্যবসায়ীরা একবার দাম বাড়িয়েছেন আবার মিল মালিক ও আড়তদাররা আরেক দফা দাম বাড়িয়েছেন, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আমাদের কাছে আসতে আসতে সেই চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবহন, শ্রমিকসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে সেই চাল বস্তাপ্রতি বিক্রি করতে হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা বেশিতে।

এদিকে চালের দামের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সবজির দামও। গতকাল বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। গ্রীষ্মকালে সবজির দাম স্থিতিশীল থাকলেও বর্ষার শুরুতে বাড়ছে। বেগুন প্রকারভেদে কেজি ৬০-৮০ টাকা, করলা ৮০, বরবটি ৮০, পটোল ৬০, ধুন্দল ৫০, চিচিঙ্গা ৬০, ঝিঙা ৬০, কচুর লতি ৭০, মুখী কচু ৮০, পেঁপে ৩০, কাঁচামরিচ ৬০-৮০ ও শজিনা ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

চাল ও সবজির দাম বাড়ার পরও মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য নিয়ে একমত নন চাকরিজীবী আমজাদ হোসেন। এক মাস আগেও ব্রি আটাশ চালের ২৫ কেজি বস্তা ১ হাজার ৩০০ টাকা দিয়ে কিনলেও গতকালের বাজারে সে বস্তা কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। কারওয়ান বাজারে চাল কিনতে আসা এ ভোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক মাস ধরে চাল, তেল, সবজির দাম বেড়ে চলছে। এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৮ টাকা বেশি দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে। সেখানে বিবিএসের এমন তথ্যের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সেখানে মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য দেয়া বিস্ময়কর।

Tag :

চালসহ অনেক পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য দিল বিবিএস

আপডেট সময় : ০৭:১৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫

দেশের খাদ্য চাহিদার বড় অংশের জোগান দেয় চাল। এবার বোরোর ভালো ফলন ও রেকর্ড আমদানি সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ছে। দুই মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী থাকা চালের সঙ্গে বাড়ছে সবজি, ডিম, মাছসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। যদিও গত অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে মূল্যস্ফীতি কমেছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।সরকারি এ সংস্থা বলছে, গত জুনে মূল্যস্ফীতির হার কমে

৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে। একই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির পরও বিবিএসের মূল্যস্ফীতি কমার তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলছে। চালের দাম বাড়লে গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়ে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। কিন্তু বিবিএস তার বিপরীত চিত্র দিচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সময়ে বিবিএসের পরিসংখ্যান নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল, সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও রয়ে গেল।

গতকাল জুনের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, জুনে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এটি ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ দেখানো হয়েছিল। এ নিয়ে টানা চার মাস মূল্যস্ফীতি কমল। বিবিএসের দাবি, গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তবে গত এক বছরে (জুলাই ২০২৪-জুন ২০২৫) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

বিবিএস বলছে, গত ছয় মাসে (ডিসেম্বর ২০২৪-জুন ২০২৫) সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। জানুয়ারিতে এটি ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ২৪, মার্চে ৮ দশমিক ৯৩, এপ্রিলে ৮ দশমিক ৬৩ ও মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সারা দেশের ৬৪ জেলার ১৫৪টি হাটবাজারের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জুনের মূল্যস্ফীতির চিত্র তৈরি করা হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে বাড়ার কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি হিটম্যাপ অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হিসাবের ক্ষেত্রে চালের ভর ধরা হয় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সবজির ভর ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। খাদ্যের মোট ভরের প্রায় ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ চাল ও সবজির অবস্থান।

বিবিএসের আর কোনো সক্ষমতা তৈরি না হলেও সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য দেয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত দেড় দশকে বিবিএস সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য তৈরি ও সরবরাহে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছে। আমরা দেখেছি, অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ নির্ধারণ করলে বিবিএস সেটি প্রমাণের তথ্য-উপাত্ত হাজির করত। আবার জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও সরকারের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিবিএস বলত, মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশেও বিবিএস আগের মতোই তথ্য-উপাত্ত তৈরি করছে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ সংস্থাটির দাবি আর বাজারের পরিস্থিতি একই কথা বলছে না। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বমুখিতা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমল সেটির ব্যাখ্যা চাওয়া দরকার।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী আরো বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সবাই বলছে মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। আমার মনে হয়, সরকারের এ চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে বিবিএস পরিসংখ্যান তৈরি করছে। বিবিএস সংস্কার ও তথ্য সংশোধনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। আমরা এখনো জানি না, গঠিত ওই কমিটি কী সুপারিশ করেছে। আর সুপারিশ আমলে নিয়ে সরকার আদৌ কোনো সংস্কার করেছে বলেও শুনিনি। মূল্যস্ফীতির তথ্য দেখে মনে হচ্ছে, বিবিএস এখনো শেখ হাসিনার দেখানো পথেই চলছে।’

রাজধানীর বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই মাস ধরে চালের দাম বেড়ে চলছে। বাজারে নাজিরশাইল ও মিনিকেটের মতো সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ৩ টাকা বাড়লেও মাঝারি ও মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫-৭ টাকা পর্যন্ত। মাঝারি পাইজাম, আটাশ চালের দাম কেজিপ্রতি ৭ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা, চায়না ইরি জাতের চালের দাম বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। মোটা চাল সব বাজারে পাওয়া যায় না বলে নিম্নবিত্তদেরও পাইজাম, আটাশ চাল কিনতে হয় বাধ্য হয়েই। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা যায়, গতকাল রাজধানীর বাজারে সরু চালের দাম ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়েছে। এক মাস আগেও এ চাল বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ৭২ টাকায়। মাঝারি চাল ৬০ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। এক মাস আগে এসব চালের দাম ছিল যথাক্রমে ৫৩ ও ৫০ টাকা।

কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘দুই মাস ধরে চালের দাম ৫-৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ৫০ টাকার মোটা চাল এখন ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, মাঝারি চাল বেড়েছে ৮ টাকা পর্যন্ত। কোরবানি ঈদের সময় থেকে দাম কমানো যায়নি। মিল মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

চালের দাম বাড়ার পেছনে চাল আড়তদার ও মিল মালিকদের দায়ী করেন খুচরা বিক্রেতারা। তারা বলেন, বোরো তোলার তিন-চার মাস না পেরোতে চালের দাম যেভাবে বেড়েছে তার পেছনে মিল মালিক ও আড়তদাররা দায়ী। তারা বোরো মৌসুমে কম দামে ধান কিনে রেখেছেন। তারা বলেন ধানের দাম বেড়েছে। কিন্তু ধানচাষীরা মূল্য পাননি। ধান ব্যবসায়ীরা একবার দাম বাড়িয়েছেন আবার মিল মালিক ও আড়তদাররা আরেক দফা দাম বাড়িয়েছেন, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আমাদের কাছে আসতে আসতে সেই চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। পরিবহন, শ্রমিকসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে সেই চাল বস্তাপ্রতি বিক্রি করতে হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা বেশিতে।

এদিকে চালের দামের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সবজির দামও। গতকাল বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। গ্রীষ্মকালে সবজির দাম স্থিতিশীল থাকলেও বর্ষার শুরুতে বাড়ছে। বেগুন প্রকারভেদে কেজি ৬০-৮০ টাকা, করলা ৮০, বরবটি ৮০, পটোল ৬০, ধুন্দল ৫০, চিচিঙ্গা ৬০, ঝিঙা ৬০, কচুর লতি ৭০, মুখী কচু ৮০, পেঁপে ৩০, কাঁচামরিচ ৬০-৮০ ও শজিনা ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

চাল ও সবজির দাম বাড়ার পরও মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য নিয়ে একমত নন চাকরিজীবী আমজাদ হোসেন। এক মাস আগেও ব্রি আটাশ চালের ২৫ কেজি বস্তা ১ হাজার ৩০০ টাকা দিয়ে কিনলেও গতকালের বাজারে সে বস্তা কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। কারওয়ান বাজারে চাল কিনতে আসা এ ভোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক মাস ধরে চাল, তেল, সবজির দাম বেড়ে চলছে। এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৮ টাকা বেশি দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে। সেখানে বিবিএসের এমন তথ্যের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সেখানে মূল্যস্ফীতি কমার তথ্য দেয়া বিস্ময়কর।