ঢাকা ০২:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এনবিআর এর নিপীড়ন নির্যাতন: অবসর, বরখাস্ত ও দুদকের তদন্তে আতঙ্কিত কর্মকর্তারা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় : ০৬:৫৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫
  • ২৪৭ বার পড়া হয়েছে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এনবিআরের সংগঠন প্রথমে মৌখিকভাবে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও তিনি তাতে রাজি হননি বলে অভিযোগ। এরপর সংগঠন লিখিতভাবে আলোচনার প্রস্তাব জানালে, সেই পত্রটি চেয়ারম্যান ছুড়ে ফেলেন বলেও জানানো হয়।

পরবর্তীতে বিসিএস ক্যাডারসহ এনবিআরের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিচ তলায় ফ্লোরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এনবিআর চেয়ারম্যান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় মেইন গেট বন্ধ করে দেন এবং আন্দোলনকারীদের নিচ তলার ফ্লোর থেকে সরিয়ে গেটের বাইরে রাস্তায় আন্দোলন করতে বাধ্য করেন।

চেয়ারম্যান আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বেছে না নিয়ে কেন এমন পদক্ষেপ নিলেন—এ প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। তিনি কেন অর্থ উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে অবহিত করেননি, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সৎ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাচ্ছেন, অথচ যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলমান, তারা বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন।

সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন—কেন সৎ কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হচ্ছে, অথচ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? এ ঘটনাকে অনেকেই প্রতিশোধপরায়ণতা হিসেবে দেখছেন।

সরকারি পদক্ষেপ

এনবিআরের চলমান আন্দোলনের পর সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে জনস্বার্থে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন:

কর বিভাগের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন

শুল্কনীতি ও আইসিটি বিভাগের সদস্য হোসেন আহমদ

মূসক নীতি বিভাগের সদস্য আবদুর রউফ

বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার মো. শব্বির আহমেদ

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তারা ২৫ বছরের চাকরিকাল পূর্ণ করেছেন এবং সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ ধারার আওতায় অবসর দেওয়া হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে—যারা ৬০ বছরের অধিক বয়সেও চাকরি করছেন, তাদের কীভাবে বহাল রাখা হচ্ছে?

এর আগে, ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ, তিনি সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে ২৮ ও ২৯ জুন কাস্টম হাউস বন্ধ রেখেছিলেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, জাকির হোসেন একজন সৎ অফিসার এবং তাকে চেয়ারম্যানের প্ররোচনায় বরখাস্ত করা হয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধান

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে ১১ জন এনবিআর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এ অনুসন্ধানের পেছনে চেয়ারম্যানের ইন্ধন রয়েছে।

আলোচনায় বসছেন যাঁরা

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ বৈঠকে বসছেন:

সদস্য এ কে এম বদিউল আলম

অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার

অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা

অতিরিক্ত কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা

অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু

যুগ্ম কমিশনার মো. মোরশেদ উদ্দীন খান

সদস্য লুতফুল আজীম

অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল রশিদ মিয়া

উপকর কমিশনার মো. শিহাবুল ইসলাম

যুগ্ম কমিশনার তারেক হাসান

সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সদস্য মো. আলমগীর হোসেন

আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়া

সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের তিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে ও সরকারের আশ্বাসে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলন প্রত্যাহারের পর যেভাবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং চরম প্রতিশোধপরায়ণতার উদাহরণ।

ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্বেগ

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “আমরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে মধ্যস্থতা করেছিলাম। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কাউকে বরখাস্ত বা হয়রানি করা হবে না। সেই আশ্বাসেই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এখন যদি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “সরকারের উচিত সহনশীলতা প্রদর্শন করা। কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দিলে দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

এনবিআরের সংস্কার আন্দোলনের পর সরকার ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া এখন কেন্দ্রে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী মহল বলছে—প্রতিশোধ নয়, এখন দরকার স্থিতিশীলতা ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধান।

Tag :

এনবিআর এর নিপীড়ন নির্যাতন: অবসর, বরখাস্ত ও দুদকের তদন্তে আতঙ্কিত কর্মকর্তারা

আপডেট সময় : ০৬:৫৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এনবিআরের সংগঠন প্রথমে মৌখিকভাবে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও তিনি তাতে রাজি হননি বলে অভিযোগ। এরপর সংগঠন লিখিতভাবে আলোচনার প্রস্তাব জানালে, সেই পত্রটি চেয়ারম্যান ছুড়ে ফেলেন বলেও জানানো হয়।

পরবর্তীতে বিসিএস ক্যাডারসহ এনবিআরের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিচ তলায় ফ্লোরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এনবিআর চেয়ারম্যান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় মেইন গেট বন্ধ করে দেন এবং আন্দোলনকারীদের নিচ তলার ফ্লোর থেকে সরিয়ে গেটের বাইরে রাস্তায় আন্দোলন করতে বাধ্য করেন।

চেয়ারম্যান আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বেছে না নিয়ে কেন এমন পদক্ষেপ নিলেন—এ প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। তিনি কেন অর্থ উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে অবহিত করেননি, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সৎ, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাচ্ছেন, অথচ যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলমান, তারা বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন।

সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন—কেন সৎ কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হচ্ছে, অথচ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? এ ঘটনাকে অনেকেই প্রতিশোধপরায়ণতা হিসেবে দেখছেন।

সরকারি পদক্ষেপ

এনবিআরের চলমান আন্দোলনের পর সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে জনস্বার্থে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন:

কর বিভাগের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন

শুল্কনীতি ও আইসিটি বিভাগের সদস্য হোসেন আহমদ

মূসক নীতি বিভাগের সদস্য আবদুর রউফ

বরিশাল কর অঞ্চলের কমিশনার মো. শব্বির আহমেদ

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তারা ২৫ বছরের চাকরিকাল পূর্ণ করেছেন এবং সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ ধারার আওতায় অবসর দেওয়া হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে—যারা ৬০ বছরের অধিক বয়সেও চাকরি করছেন, তাদের কীভাবে বহাল রাখা হচ্ছে?

এর আগে, ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ, তিনি সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে ২৮ ও ২৯ জুন কাস্টম হাউস বন্ধ রেখেছিলেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, জাকির হোসেন একজন সৎ অফিসার এবং তাকে চেয়ারম্যানের প্ররোচনায় বরখাস্ত করা হয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধান

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে ১১ জন এনবিআর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এ অনুসন্ধানের পেছনে চেয়ারম্যানের ইন্ধন রয়েছে।

আলোচনায় বসছেন যাঁরা

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ বৈঠকে বসছেন:

সদস্য এ কে এম বদিউল আলম

অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার

অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা

অতিরিক্ত কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা

অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু

যুগ্ম কমিশনার মো. মোরশেদ উদ্দীন খান

সদস্য লুতফুল আজীম

অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল রশিদ মিয়া

উপকর কমিশনার মো. শিহাবুল ইসলাম

যুগ্ম কমিশনার তারেক হাসান

সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সদস্য মো. আলমগীর হোসেন

আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়া

সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের তিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধে ও সরকারের আশ্বাসে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলন প্রত্যাহারের পর যেভাবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং চরম প্রতিশোধপরায়ণতার উদাহরণ।

ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্বেগ

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “আমরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে মধ্যস্থতা করেছিলাম। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কাউকে বরখাস্ত বা হয়রানি করা হবে না। সেই আশ্বাসেই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এখন যদি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।”

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “সরকারের উচিত সহনশীলতা প্রদর্শন করা। কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দিলে দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

এনবিআরের সংস্কার আন্দোলনের পর সরকার ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া এখন কেন্দ্রে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী মহল বলছে—প্রতিশোধ নয়, এখন দরকার স্থিতিশীলতা ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধান।