ঢাকা ০৩:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই টানাপোড়েনে বাংলাদেশ, বাড়ছে চাপ

  • অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৮:১৫:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫
  • ৪৮ বার পড়া হয়েছে

প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার কোনোটির সঙ্গেই এই মুহূর্তে স্বাভাবিক সম্পর্কে নেই বাংলাদেশ। এই সম্পর্ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে বদলাবে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।

সবশেষ গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন খোলাখুলি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের রিঅ্যাডজাস্টমেন্ট চলছে। আর মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক গত সাত-আট বছরে কোনো অগ্রগতি নেই।

দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই বিরূপ সম্পর্ক অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় আটকে রয়েছে। তবে কিছুদিন আগেও ‘প্রধান কৌশলগত মিত্র’ এবং প্রধান প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্যে বিভিন্ন প্রভাব পড়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক সরকার আসার পর পরিস্থিতি বদলানোর সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের সমস্যা কখন সমাধান হবে, তা কেউ জানেন না।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সিংহভাগ মানুষের বিশ্বাস ভারত দুই দেশের নাগরিকদের সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ না দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনাও একের পর এক অসম চুক্তি করে গেছেন দেশের মানুষকে একরকম অন্ধকারে রেখেই। দুই দেশেরই উচিত তাদের পররাষ্ট্র কৌশলের ভুল-ত্রুটি দেখা।

‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ধারাবাহিক। কিন্তু নতুন সরকার আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না।’- অধ্যাপক এহসানুল হক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, ‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ধারাবাহিক। কিন্তু নতুন সরকার আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। তিস্তা নদীর পানির বণ্টন, সীমান্ত হত্যাসহ নানান সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা কঠিন।’

দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই টানাপোড়েনে বাংলাদেশ, বাড়ছে চাপসাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কেবল বাণিজ্য বা কূটনৈতিক নয়, এটি মানুষে মানুষে যোগাযোগ, পারস্পরিক নির্ভরতা এবং সীমান্তবর্তী জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।

‘বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা মূলত দুই দেশের এলিট শ্রেণির দ্বন্দ্ব। কিন্তু এর প্রকৃত ভুক্তভোগী হচ্ছেন সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষ। তাদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই, ফলে তারা নীরবে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন,’ বলেন আবদুল হাই।

দেশে জনবান্ধব ও রাজনৈতিক সরকারের অভাবকে এজন্য দায়ী করেন সাবেক এই পেশাদার কূটনীতিক।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিঃশর্তভাবে সমর্থন দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের এমন পতনকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি ভারত। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে অস্বাভাবিক এক টানাপোড়েন পড়ে।

শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনতে দাবি তুলেছে বর্তমান সরকার। চিঠি দেওয়া হয়েছে ভারতকে। সেই সঙ্গে দিল্লিতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগও করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে।

এই পটভূমিতে ভারতও চুপ থাকেনি। তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা, অপতথ্য এবং অতিরঞ্জিত প্রচারণা চালাচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্কে আরও অস্থিরতা তৈরি করছে।

সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে কূটনীতিক তলব এবং শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে কূটনৈতিক চাপ-সৃষ্টি পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার, সমমর্যাদা এবং পারস্পরিক চাওয়ার ভিত্তিতেই ভারতে সংশোধিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব বিষয়ের সমাধানের অপেক্ষায় ভারত। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আগেও বহুবার গঠনমূলক বৈঠকে আলোচনা করেছি, এমনকি সচিব পর্যায়েও।- ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় সমতার ভিত্তিতে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে—এটাই আমরা বলে আসছি। এটার জন্য আমরা কাজ করছি।’

আগের সরকারের ভারতপন্থি নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যেটা আমাদের জন্য ভালো আমরা সেটাই করবো। আমাদের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তো পিরিতি করবো না।’

‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি উইন-উইন। উইন-লুজ সিচুয়েশন হয়, যখন কেউ বেকায়দায় পড়ে, পরিস্থিতির শিকার হয়। তখন একপক্ষকে ছাড় দিতে হয়। সেরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পড়েছে নাকি?’ প্রশ্ন ছোড়েন তিনি।

ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার ছায়া পড়েছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও। সর্বশেষ ভারত গত শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে (মুম্বাইয়ের নভো সেবা বন্দর বাদে) ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়। নিষিদ্ধ তালিকায় প্রধানত পাট ও পাটজাত পণ্য রয়েছে। যার মধ্যে কাঁচা পাট, পাটের রোল, সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় রয়েছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওই ৯টি পণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রায় ১৫ কোটি ডলারের কাছাকাছি ছিল, যার অধিকাংশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠানো হতো। তবে নেপাল ও ভুটানে এসব পণ্য রপ্তানিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই।

এ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ আরোপ করলো ভারত। এর আগে গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল। গত ৯ এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল দেশটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব অনেক। গত বছর বাংলাদেশ ভারতে ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে পোশাক ও পাটজাত পণ্যের বড় অংশ রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারত থেকে ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।

‘এই রাজনৈতিক উত্তেজনায় প্রকৃত ক্ষতি হচ্ছে সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষের। যারা স্থলবন্দরের আশপাশে ব্যবসা, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা পরিবহন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আঞ্চলিক বাণিজ্যে স্থলবন্দরগুলো ব্যবহার না হলে তাদের কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, আর বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এটি জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে।’- সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর ভারতে প্রায় ৩১ শতাংশ পণ্যের রপ্তানিতে বাধার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ, যা ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। স্থলবন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহন ও খালাসের ওপর হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নির্ভর করে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই বলেন, ‘এই রাজনৈতিক উত্তেজনায় প্রকৃত ক্ষতি হচ্ছে সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষের। যারা স্থলবন্দরের আশপাশে ব্যবসা, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা পরিবহন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আঞ্চলিক বাণিজ্যে স্থলবন্দরগুলো ব্যবহার না হলে তাদের কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, আর বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এটি জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে।’

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যে বাংলাদেশের সামান্য ক্ষতি হয়েছে, যদিও বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি এবং বিকল্প পথে বাণিজ্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘তারা (ভারত) বাণিজ্য বন্ধ করেছে, তাই বলে বাংলাদেশের বাণিজ্য বন্ধ থাকবে নাকি? কাঁচামাল আমদানি কি থেমে যাবে? আমাদের তো বন্দর, আকাশপথ চালু আছে। যে রাষ্ট্র দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত সেই দেশ যদি বাণিজ্য বা কাঁচামাল বন্ধ করে দেয়, তাহলে সেটা তো জোর করে আদায় করতে পারবো না।’

‘তারা এসব কাজ করতেই পারে। কারণ তাদের অর্থনীতি অনেক বড়। আমাদের অর্থনীতি ছোট হলেও ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য কানেকটিভিটি আছে। সেগুলো তো ব্যাঘাত হচ্ছে না। আমরা অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল আনছি, যদিও খরচ একটু বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের ব্যবসা তো ফ্লপ করবে না। সেখানে বর্তমান সরকারের কম্প্রোমাইজেরও ইস্যু নেই, বলেন তিনি।

‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল আমি বলতে চাই না। আমি বলছি যে এটা একটা রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের (পুনর্বিন্যাস) পর্যায়ে আছে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।’ –পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন

তবে এ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল আমি বলতে চাই না। আমি বলছি যে এটা একটা রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের (পুনর্বিন্যাস) পর্যায়ে আছে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।’

এদিকে শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, পারস্পরিক লাভজনক সংলাপের ‘অনুকূল পরিবেশে’ বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনায় প্রস্তুত ভারত।

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার, সমমর্যাদা এবং পারস্পরিক চাওয়ার ভিত্তিতেই ভারতে সংশোধিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব বিষয়ের সমাধানের অপেক্ষায় ভারত। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আগেও বহুবার গঠনমূলক বৈঠকে আলোচনা করেছি, এমনকি সচিব পর্যায়েও।

‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে খুব কম অগ্রগতি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে কিছু আশার আলো দেখিয়েছিল, তবু এখন পরিস্থিতি খুব একটা উন্নয়নশীল নয়।’- অধ্যাপক এহসানুল হক
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরানো সম্ভব হয়নি। আরাকানে আবারও যুদ্ধাবস্থা চলায় এ বছর আরও প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে খুব কম অগ্রগতি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে কিছু আশার আলো দেখিয়েছিল, তবু এখন পরিস্থিতি খুব একটা উন্নয়নশীল নয়।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক শাসন চলছে। ২০২৫ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কিছু পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যু এখনো অমীমাংসিত।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বন্দ্ব নেই, শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়া। রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান তাদের নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তা এখনো সম্ভব হয়নি। নানান প্রচেষ্টা চললেও এখনো প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি নেই।

‘যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন ভারতকে হ্যান্ডেল করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেশাল মেজরস নেওয়া উচিত, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’ -অধ্যাপক এহসানুল হক

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ভারতের আগ্রহের বিষয়ে কূটনীতিক মহলে নানান আলোচনা শোনা যায়। এমন একাধিক কূটনীতিক জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তারাও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়। তবে তা নতুন রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে করতে চায়। এজন্য বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে তারা।

অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে ভারত সবসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকবে। এটার কোনো পরিবর্তন হবে না।

‘তবে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন ভারতকে হ্যান্ডেল করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেশাল মেজরস নেওয়া উচিত, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ’, বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে জুলাইয়ের আত্মত্যাগের কথা মাথায় রাখতে হবে। যাদের উদ্দেশ্য হবে নতজানু পররাষ্ট্র নীতি থেকে বের হয়ে কোমর শক্ত করে চলা।’

Tag :

দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই টানাপোড়েনে বাংলাদেশ, বাড়ছে চাপ

আপডেট সময় : ০৮:১৫:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫

প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার কোনোটির সঙ্গেই এই মুহূর্তে স্বাভাবিক সম্পর্কে নেই বাংলাদেশ। এই সম্পর্ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে বদলাবে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।

সবশেষ গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন খোলাখুলি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের রিঅ্যাডজাস্টমেন্ট চলছে। আর মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক গত সাত-আট বছরে কোনো অগ্রগতি নেই।

দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই বিরূপ সম্পর্ক অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় আটকে রয়েছে। তবে কিছুদিন আগেও ‘প্রধান কৌশলগত মিত্র’ এবং প্রধান প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্যে বিভিন্ন প্রভাব পড়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক সরকার আসার পর পরিস্থিতি বদলানোর সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের সমস্যা কখন সমাধান হবে, তা কেউ জানেন না।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সিংহভাগ মানুষের বিশ্বাস ভারত দুই দেশের নাগরিকদের সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগ না দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনাও একের পর এক অসম চুক্তি করে গেছেন দেশের মানুষকে একরকম অন্ধকারে রেখেই। দুই দেশেরই উচিত তাদের পররাষ্ট্র কৌশলের ভুল-ত্রুটি দেখা।

‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ধারাবাহিক। কিন্তু নতুন সরকার আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না।’- অধ্যাপক এহসানুল হক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, ‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ধারাবাহিক। কিন্তু নতুন সরকার আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না। তিস্তা নদীর পানির বণ্টন, সীমান্ত হত্যাসহ নানান সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা কঠিন।’

দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই টানাপোড়েনে বাংলাদেশ, বাড়ছে চাপসাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কেবল বাণিজ্য বা কূটনৈতিক নয়, এটি মানুষে মানুষে যোগাযোগ, পারস্পরিক নির্ভরতা এবং সীমান্তবর্তী জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।

‘বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা মূলত দুই দেশের এলিট শ্রেণির দ্বন্দ্ব। কিন্তু এর প্রকৃত ভুক্তভোগী হচ্ছেন সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষ। তাদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই, ফলে তারা নীরবে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন,’ বলেন আবদুল হাই।

দেশে জনবান্ধব ও রাজনৈতিক সরকারের অভাবকে এজন্য দায়ী করেন সাবেক এই পেশাদার কূটনীতিক।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিঃশর্তভাবে সমর্থন দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের এমন পতনকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি ভারত। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে অস্বাভাবিক এক টানাপোড়েন পড়ে।

শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনতে দাবি তুলেছে বর্তমান সরকার। চিঠি দেওয়া হয়েছে ভারতকে। সেই সঙ্গে দিল্লিতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগও করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে।

এই পটভূমিতে ভারতও চুপ থাকেনি। তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা, অপতথ্য এবং অতিরঞ্জিত প্রচারণা চালাচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্কে আরও অস্থিরতা তৈরি করছে।

সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি, সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে কূটনীতিক তলব এবং শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে কূটনৈতিক চাপ-সৃষ্টি পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার, সমমর্যাদা এবং পারস্পরিক চাওয়ার ভিত্তিতেই ভারতে সংশোধিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব বিষয়ের সমাধানের অপেক্ষায় ভারত। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আগেও বহুবার গঠনমূলক বৈঠকে আলোচনা করেছি, এমনকি সচিব পর্যায়েও।- ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় সমতার ভিত্তিতে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে—এটাই আমরা বলে আসছি। এটার জন্য আমরা কাজ করছি।’

আগের সরকারের ভারতপন্থি নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যেটা আমাদের জন্য ভালো আমরা সেটাই করবো। আমাদের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তো পিরিতি করবো না।’

‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি উইন-উইন। উইন-লুজ সিচুয়েশন হয়, যখন কেউ বেকায়দায় পড়ে, পরিস্থিতির শিকার হয়। তখন একপক্ষকে ছাড় দিতে হয়। সেরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পড়েছে নাকি?’ প্রশ্ন ছোড়েন তিনি।

ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার ছায়া পড়েছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও। সর্বশেষ ভারত গত শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে (মুম্বাইয়ের নভো সেবা বন্দর বাদে) ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়। নিষিদ্ধ তালিকায় প্রধানত পাট ও পাটজাত পণ্য রয়েছে। যার মধ্যে কাঁচা পাট, পাটের রোল, সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় রয়েছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওই ৯টি পণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রায় ১৫ কোটি ডলারের কাছাকাছি ছিল, যার অধিকাংশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাঠানো হতো। তবে নেপাল ও ভুটানে এসব পণ্য রপ্তানিতে কোনো বিধিনিষেধ নেই।

এ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে তিন মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ আরোপ করলো ভারত। এর আগে গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল। গত ৯ এপ্রিল ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল দেশটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব অনেক। গত বছর বাংলাদেশ ভারতে ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে পোশাক ও পাটজাত পণ্যের বড় অংশ রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারত থেকে ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।

‘এই রাজনৈতিক উত্তেজনায় প্রকৃত ক্ষতি হচ্ছে সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষের। যারা স্থলবন্দরের আশপাশে ব্যবসা, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা পরিবহন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আঞ্চলিক বাণিজ্যে স্থলবন্দরগুলো ব্যবহার না হলে তাদের কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, আর বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এটি জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে।’- সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর ভারতে প্রায় ৩১ শতাংশ পণ্যের রপ্তানিতে বাধার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ, যা ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। স্থলবন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহন ও খালাসের ওপর হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নির্ভর করে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই বলেন, ‘এই রাজনৈতিক উত্তেজনায় প্রকৃত ক্ষতি হচ্ছে সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষের। যারা স্থলবন্দরের আশপাশে ব্যবসা, হোটেল-রেস্তোরাঁ বা পরিবহন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আঞ্চলিক বাণিজ্যে স্থলবন্দরগুলো ব্যবহার না হলে তাদের কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, আর বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এটি জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে।’

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যে বাংলাদেশের সামান্য ক্ষতি হয়েছে, যদিও বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি এবং বিকল্প পথে বাণিজ্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘তারা (ভারত) বাণিজ্য বন্ধ করেছে, তাই বলে বাংলাদেশের বাণিজ্য বন্ধ থাকবে নাকি? কাঁচামাল আমদানি কি থেমে যাবে? আমাদের তো বন্দর, আকাশপথ চালু আছে। যে রাষ্ট্র দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত সেই দেশ যদি বাণিজ্য বা কাঁচামাল বন্ধ করে দেয়, তাহলে সেটা তো জোর করে আদায় করতে পারবো না।’

‘তারা এসব কাজ করতেই পারে। কারণ তাদের অর্থনীতি অনেক বড়। আমাদের অর্থনীতি ছোট হলেও ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য কানেকটিভিটি আছে। সেগুলো তো ব্যাঘাত হচ্ছে না। আমরা অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল আনছি, যদিও খরচ একটু বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের ব্যবসা তো ফ্লপ করবে না। সেখানে বর্তমান সরকারের কম্প্রোমাইজেরও ইস্যু নেই, বলেন তিনি।

‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল আমি বলতে চাই না। আমি বলছি যে এটা একটা রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের (পুনর্বিন্যাস) পর্যায়ে আছে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।’ –পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন

তবে এ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল আমি বলতে চাই না। আমি বলছি যে এটা একটা রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের (পুনর্বিন্যাস) পর্যায়ে আছে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।’

এদিকে শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, পারস্পরিক লাভজনক সংলাপের ‘অনুকূল পরিবেশে’ বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনায় প্রস্তুত ভারত।

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার, সমমর্যাদা এবং পারস্পরিক চাওয়ার ভিত্তিতেই ভারতে সংশোধিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব বিষয়ের সমাধানের অপেক্ষায় ভারত। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আগেও বহুবার গঠনমূলক বৈঠকে আলোচনা করেছি, এমনকি সচিব পর্যায়েও।

‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে খুব কম অগ্রগতি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে কিছু আশার আলো দেখিয়েছিল, তবু এখন পরিস্থিতি খুব একটা উন্নয়নশীল নয়।’- অধ্যাপক এহসানুল হক
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরানো সম্ভব হয়নি। আরাকানে আবারও যুদ্ধাবস্থা চলায় এ বছর আরও প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে খুব কম অগ্রগতি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে কিছু আশার আলো দেখিয়েছিল, তবু এখন পরিস্থিতি খুব একটা উন্নয়নশীল নয়।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক শাসন চলছে। ২০২৫ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কিছু পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যু এখনো অমীমাংসিত।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বন্দ্ব নেই, শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়া। রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান তাদের নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তা এখনো সম্ভব হয়নি। নানান প্রচেষ্টা চললেও এখনো প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি নেই।

‘যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন ভারতকে হ্যান্ডেল করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেশাল মেজরস নেওয়া উচিত, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’ -অধ্যাপক এহসানুল হক

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ভারতের আগ্রহের বিষয়ে কূটনীতিক মহলে নানান আলোচনা শোনা যায়। এমন একাধিক কূটনীতিক জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। তারাও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়। তবে তা নতুন রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে করতে চায়। এজন্য বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে তারা।

অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে ভারত সবসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকবে। এটার কোনো পরিবর্তন হবে না।

‘তবে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন ভারতকে হ্যান্ডেল করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেশাল মেজরস নেওয়া উচিত, যা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ’, বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে জুলাইয়ের আত্মত্যাগের কথা মাথায় রাখতে হবে। যাদের উদ্দেশ্য হবে নতজানু পররাষ্ট্র নীতি থেকে বের হয়ে কোমর শক্ত করে চলা।’